এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার তরছঘাট পয়েন্টে অবশেষে মাতামুহুরী নদীতে একটি পাকা সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর মধ্যদিয়ে এতদাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ দেখছেন নতুন সূর্যের উদয়। চকরিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর চৌধুরীর আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ের পরিকল্পনা-১ শাখার উপসচিব মো.আল আমিন সরকার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের আলোকে সম্প্রতিসময়ে মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টে একটি পাকা সেতু নির্মাণের নীতিগতভাবে চুড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এরই আলোকে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কক্সবাজার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটিদল প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণের স্থানে দুইদফা সরেজমিনে সমীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু টিকটাক থাকলে অতিসহসা মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টে এলজিইডির অর্থায়নে পাকা সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করে এমনটাই নিশ্চিত করেছেন চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী। দীর্ঘ ৫০বছর ধরে সেতু নির্মাণের খবরে সর্বসাধারণের মাঝে খুশির আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর জনসাধারণ এইধরণের একটি কাজের জন্য চকরিয়া পৌরসভার মেয়রকে দিচ্ছেন সাধুবাদ।
সরেজমিনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর পুর্বাংশে পড়েছে চকরিয়া পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের তরছঘাট এলাকা, অন্যদিকে পশ্চিমাংশে পড়েছে উপজেলার পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়ন। দেশ স্বাধীনের পর থেকে অদ্যবদি মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টে প্রবহমান খেয়াঘাট জেলা পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর কক্সবাজার জেলা পরিষদ এই খেয়াঘাট ইজারা দিয়ে আসছে।
স্থানীয় জনগনের অভিযোগ, খেয়াঘাট থাকলেও একসময় নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। ছোট আকারের এসব নৌকা করে জনসাধারণ পারাপার হতে গিয়ে অনেকসময় নৌকাডুবির ঘটনাও ঘটেছে। এই অবস্থার উত্তোরণে গেল দেড়যুগের বেশিসময় ধরে ইজারাদারপক্ষ নিজেদের অর্থায়নে খেয়াঘাটের নৌকার পরিবর্তে অস্থায়ী কাঠের সেতু নির্মাণ করে পারাপার কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন।
পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়নের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কালাম চাষী বলেন, বছরের ছয় মাস কাঠের সেতু দিয়ে ও অবশিষ্ট সময় নৌকা দিয়ে চলাচল করতে হয় জনসাধারণকে। আবার বর্ষা মৌসুমে নদী পার হতে হিমশিম খেতে হয়। বিশেষত বর্ষায় মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে পানি বৃদ্ধি পেলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যাওয়া-আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে নদীর পশ্চিমাংশের চার ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ দীর্ঘসময় ধরে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
অপরদিকে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, কাঠের সেতু দিয়ে মানুষ হেটে পারাপার করতে পারলেও নদীর পশ্চিমাংশে অবস্থিত তিনটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ জমিতে উৎপাদিত ফসল গাড়িতে করে পরিবহন করা একেবারে সম্ভব হতো না। কারণ কাঠের সেতুর ধারণক্ষমতা পন্যবাহি গাড়ি চলাচলের মতো না।
পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারহানা আফরিন মুন্না বলেন, মাতামুহুরী নদীরন তরছঘাট পয়েন্টের খেয়াঘাট তথা কাঠের সেতু দিয়ে প্রতিদিন উপজেলার পুর্ববড় ভেওলা, সাহারবিল, বিএমচর, কোনাখালী ইউনিয়নের হাজারো জনসাধারণ উপজেলা সদরে যান। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও এই কাঠের সেতু দিয়ে চলাচল করেন।
আবার এই চারটি ইউনিয়নের বির্স্তীণ জমিতে প্রতিবছর উৎপাদিত কৃষিপন্য তথা রকমারি ফসল সহজে বাজারজাত করতে পারেনা কৃষকেরা। কারণ কাঠের সেতু দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারলেও কৃষিপন্য বাহি গাড়ি চলাচলের সক্ষমতা নেই কাঠের তৈরী এই সেতুর। এ অবস্থার কারণে গাড়িযোগে যেমন জনসাধারণ বাড়ি ফিরতে পারেনা, তেমনি কৃষিপন্য বাহি গাড়িও পারাপার না হওয়ায় উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করা নিয়ে কৃষকদের ভোগান্তি রয়েছে সীমহীন।
সরেজমিনে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টের খেয়াঘাট তথা কাঠের সেতু দিয়ে চলাচল করতে হয় সাহারবিল ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের মানুষকে। একইভাবে পূর্ববড় ভেওলা ইউনিয়নের মাবিয়াবাপের পাড়া, আনিসপাড়া, সেকান্দর পাড়া, নোয়াপাড়া, বুড়ির পাড়া, খরি বাপের পাড়া, কালাগাজী সিকদার পাড়া, ফজল রহমান সিকদার পাড়া, অলি বাপের সিকদার পাড়া, শাহাবখান পাড়া ও পূর্ব নয়াপাড়া গ্রামের লোকজনও চলাচলের ক্ষেত্রে কাঠের সেতুটি ব্যবহার করছেন দীর্ঘযুগ ধরে। মুলত ওইসব এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে উপজেলা সদরে আসতে যাতায়াতে কাঠের সাঁকোটিই একমাত্র ভরসা ৫০ হাজার মানুষের। বর্তমানে ওইসব গ্রামের মানুষ উল্টোদিকে ৫ কিলোমিটার ঘুরে বাটাখালী সেতু পার হয়ে উপজেলা সদরে আসতে হয়।
চকরিয়া পৌরসভার তরছঘাট এলাকার বাসিন্দা মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী জসনে আরা বুলবুল বলেন, তরছঘাট পয়েন্টে মাতামুহুরী নদীতে একটি সেতুর অভাবে সুবিধাবঞ্চিত কৃষকরা প্রচুর সবজি উৎপাদন করেও পরিবহন সুবিধার অভাবে সঠিকসময়ে বাজারজাত করতে পারেনা। তাতে কৃষকরা সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, যাতায়াত দুর্ভোগের কারণে নদীর ওই তীরের মানুষ অনেকটা উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন। এছাড়া অসুস্থ রোগীর তড়িৎ চিকিৎসার ক্ষেত্রে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। ফলে হাসপাতালে নেয়ার পথে অনেক সময় গর্ভবতী মা ও শিশুর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।
চকরিয়া পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইখতেয়ারুল ইসলাম হানিফ ও ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুহাম্মদ নুরুস শফি বলেন, তরছঘাট স্টেশনটি একসময় চকরিয়া উপজেলার বাণিজ্যিক শহর ছিল। দুইযুগ আগেও এখানকার শতাধিক দোকান থেকে সবধরণের মালামাল সওদা করতো মহেশখালী-কুতুবদিয়া উপজেলার ব্যবসায়ীরা। এসব মালামাল পরিবহন করা মতো সাম্পান ও নৌকা বোট যুগে। কিন্তু খেয়াঘাট পয়েন্টে স্থায়ী পাকা সেতু না থাকায় পন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সংকট ও দুর্ভোগ তৈরী হয়। আর তাতে জৌলুসময় বাণিজ্যিক শহরটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত ঘটে। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট নিয়ে স্থান বদলে চলে যান উপজেলা সদরে।
তাঁরা বলেন, একটু দেরীতে হলেও চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী তরছঘাট পয়েন্টের খেয়াঘাট তথা বিলুপ্ত বাণিজ্যিক শহরের দৈন্যদশা লাগবে এগিয়ে এসেছেন। তিনি পাকা সেতু নির্মাণে সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ে আবেদন করেছেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় সেতুটি নির্মাণে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পরে বদলে যাবে এই জনপদ।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী বলেন, পৌরসভার তরছঘাট ও পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের জনসাধারণ দীর্ঘদিন ধরে মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টে একটি পাকা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। জনগনের এই দাবিটি ছিল অবশ্যই যোক্তিক। বিষয়টি নিয়ে আমি স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ এর সঙ্গে কথা বলি। তাঁর সহযোগিতায় কিছুদিন আগে মন্ত্রানালয়ে একটি আবেদন জমা দিই।
তিনি বলেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারী স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয়ের পরিকল্পনা-১ শাখার উপসচিব মো.আল আমিন সরকার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টে একটি পাকা সেতু নির্মাণের নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এরই আলোকে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কক্সবাজার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটিদল প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণের স্থানে দুইদফা সরেজমিনে সমীক্ষাও সম্পন্ন করেছেন। সবকিছু টিকটাক থাকলে অতিসহসা মাতামুহুরী নদীর তরছঘাট পয়েন্টে এলজিইডির অর্থায়নে পাকা সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করে এমনটাই নিশ্চিত করেছেন চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী।##
পাঠকের মতামত: